সওম ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ
ইব্ন উমার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বস্তুর ওপর রাখা হয়েছে : সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ সম্পাদন করা ও রমজানের সওম পালন করা।’ [বুখারী: ৮, মুসলিম: ১৬]
আবু জামরাহ নসর ইব্ন ইমরান রাহিমাহুল্লাহু বলেন, ‘একদা আমি ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও শ্রোতাদের মাঝে দোভাষীর কাজ করছিলাম। তিনি বললেন, আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি গ্রুপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হন, তিনি তাদের বলেন, কোন গ্রুপ বা সম্প্রদায়ের লোক? তারা বলল, আমরা রাবিয়াহ গোত্রের। তিনি বললেন, স্বাগতম প্রতিনিধি গ্রুপ বা স্বাগতম রাবিয়াহ সম্প্রদায়, তিরস্কার ও ভর্ৎসনামুক্ত। তারা বলল, আমরা আপনার নকাছে আগমন করি অনেক দূর থেকে। আপনার ও আমাদের মাঝে রয়েছে মুদার গোত্রের কাফেরদের এ গ্রাম, এজন্য হারাম তথা সম্মানিত ও যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস ব্যতীত আপনার কাছে আমরা আসতে পারি না। অতএব আমাদেরকে উপদেশ দিন, যা আমরা আমাদের রেখে আসা ভাইদের কাছে পৌঁছাব এবং যার ওপর আমল করে আমরা সকলে জান্নাতে যাব। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন চারটি বিষয়ের : নির্দেশ দিলেন এক আল্লাহর ওপর ঈমানের। তিনি বললেন, তোমরা কি জান আল্লাহর ওপর ঈমান কী? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন–
‘সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমজানের সওম পালন করা ও গনিমতের এক পঞ্চমাংশ দান করা… এগুলো মনে রাখ ও তোমাদের রেখে আসা ভাইদের বলো।’ [বুখারী: ৮৭, মুসলিম: ১৬]
১. প্রশ্ন: রমযান মাস নির্ণয় করার সঠিক পন্থা কী?
জবাব: রমযান মাসের সূচনা প্রমাণ করার উপায় তিনটি:
১. শা’বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হওয়া। শা”বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হবার সাথে সাথেই রমযান মাস শুরু হয়ে যাবে । কারণ, চন্দ্র মাস ত্রিশ দিনের বেশি হয়না ।
২. চাঁদ দেখা । শাবান মাসের ২৯ তারিখে রমযানের চাঁদ দেখতে হবে। যদি আকাশে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে রমযান মাস শুরু হবে। কমপক্ষে বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন একজন বিশ্বস্ত মু’মিন ব্যক্তি চাঁদ দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দিতে হবে।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ (রমযান মাস সমাপ্ত) করো । যদি চাঁদ দেখতে না পাও, সে ক্ষেত্রে শাবান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করো। (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন, লোকেরা চাঁদ দেখাদেখি করলো (কিন্ত তারা কেউ চাঁদ দেখেনি, আমি দেখলাম)। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানালাম, “আমি চাঁদ দেখেছি।’ তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখলেন এবং সবাইকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ, হাকিম, ইবনে হিব্বান)
৩. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রমযান মাস নির্ধারণ । মহাকাশ বিজ্ঞানের (জ্যোতিষ শাস্ত্রের) ভিত্তিতে পৃথিবীতে চাঁদ দেখা যাবার তারিখ পূর্ব থেকেই জানা যায়। সে হিসেবে সারা পৃথিবীতে এককভাবে একই দিন রমযান মাস ও রোযা শুরু করা যায়। শেষোক্ত পদ্ধতিটিও হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক নয় । তবে -এ পদ্ধতি এখনো আমাদের দেশে সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি ।
২. প্রশ্ন: রোজা ফরজ হবার শর্ত কি কি?
জবাব: রোজা ফরজ হবার শর্তাবলি হলো,
০১. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ের ওপর রোজা ফরজ নয়।
০২. মুসলিম হওয়া। অমুসলিমের ওপর রোজার বিধান নেই।
০৩. সজ্ঞান হওয়া । কারণ, পাগল, অজ্ঞান ও অচেতন ব্যক্তির উপর কোনো ফরজ বর্তায়না।
০৪. শারীরিক সামর্থ থাকা। যেমন অতি বৃদ্ধ ও দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্তদের জন্যে ফরজ নয়।
০৫. শরয়ী সামর্থ থাকা। যেমন হায়েয-নেফাস থেকে মুক্ত হওয়া ।
০৬. শরয়ী মুসাফির না হওয়া। কারণ মুসাফিরের জন্য রোজা ফরজ নয়।
৩. প্রশ্ন: রোজার ফরজ কয়টি ও কি কি?
জবাব: রোজার ফরজ দুইটি:
১. ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা।
২. রোজা রাখার নিয়্যত বা সংকল্প করা। অর্থাৎ যেদিন রোজা রাখবেন, সেদিনকার রোজা রাখার নিয়ত করবেন। সহীহ মত হলো, দুপুরের আগেই নিয়্যত করতে হবে। নিয়ত মুখে বলার প্রয়োজন নেই। মনে মনে সংকল্প করলেই যথেষ্ট। তবে মুখে বললেও ক্ষতি নেই।
৪. প্রশ্ন: রোজা কয় প্রকার ও কি কি?
জবাব: রোজা চার প্রকার: ১. ফরয রোজা, ২. হারাম রোজা, ৩. মুস্তাহাব রোজা, ৪. মাকরূহ রোজা ।
রমজানের রোযা ফরজ। এ মাসের রোজা কাজা করলেও তা ফরজ। কাফফারা এবং মানতের রোজাও ফরজ। অবশ্য শেষোক্ত দুটি কোনো কোনো মাযহাবের মতে ওয়াজিব। ঈদুল ফিতরের দিন রোজা রাখা হারাম। ঈদুল আযহার দিন এবং ঈদুল আযহার পরবর্তী তিনদিন রোজা রাখা হারাম।
প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখা মুস্তাহাব । মহরম মাসের ৯ ও ১০ তারিখে রোজা রাখা মুস্তাহাব । যিলহজ্জের ৯ তারিখে (যারা হজ্জে গমন করেনি তাদের জন্যে) রোজা রাখা মুস্তাহাব । শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা রাখা মুস্তাহাব । প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা মুস্তাহাব । মুস্তাহাব রোজাকে কোনো কোনো মাযহাবে সুন্নত রোজাও বলা হয়। এর বাইরে রোযা রাখলে তা হবে নফল রোজা ।
৫। প্রশ্ন: কাদের উপর রোজা রাখা ফরজ নয়?
জবাব: যাদের উপর রোজা রাখা ফরজ নয়, তারা হলো:
০১. মাসিক চলাকালে নারীদের উপর রোজা ফরজ নয়। (কাজা করা ফরজ)
০২. নিফাস চলাকালে নারীদের উপর রোজা ফরজ নয়। (কাজা করা ফরজ)
০৩. উম্মাদ।
০৪. নাবালেগ শিশু কিশোর ।
০৫. রোগী।
০৬. মুসাফির । (কাজা করা ফরজ)
০৭. গর্ভবতী ।
০৮. স্তন্যদানকারী মা।
০৯. অতিশয় বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা ।
১০. অমুসলিম ।
৬। সওম ভঙ্গের কারণ কি কি?
জবাবঃ
১। সহবাস
২। হস্তমৈথুন
৩। পানাহার
৪। যা কিছু পানাহারের স্থলাভিষিক্ত
৫। শিঙ্গা লাগানো কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন কারণে রক্ত বের হওয়া
৬। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা
৭। মহিলাদের হায়েয ও নিফাসের রক্ত বের হওয়া
৭। কি কি কারণে সওম ভাঙে না?
জবাবঃ
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলা-বালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. নাক, কান, চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত বা খাবার খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।
৮। রোজা মাকরূহ হওয়ার কারণসমূহ কি কি?
জবাবঃ ১। অযুর সময় গড়গড়া করে কুলি করা, জোর দিয়ে নাকে পানি টানা। এতে গলা বা নাক দিয়ে ভিতরে পানি প্রবেশ করার সম্ভাবনা থেকে যায়।
২। অনাবশ্যক কোনো জিনিস চিবানো বা চেখে দেখা।
৩। থুথু কফ মুখে জমিয়ে গিলে ফেলা। অবশ্য সামান্য থুথু গিলে ফেললে কোন অসুবিধা নেই।
৪। যৌন অনুভূতি নিয়ে স্ত্রীকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করা, বার বার তার দিকে তাকানো, বার বার সহবাসের কল্পনা করা। কারণ এসব কার্যক্রমে বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
৫। পরনিন্দা করা, মিথ্যা বলা, চোগলখুরী করা, অনর্থক কথাবার্তা বলা ও যেকোন গুনাহের কাজ করা।
৬। রোজা অবস্থায় ঝগড়া করা, গালি-গালাজ করা।
৭। রোজা অবস্থায় টুথপেস্ট-মাজন ব্যবহার করা মাকরুহ। কেননা তা কণ্ঠনালীতে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যায়।
৮। গোসল ফরজ অবস্থায় রোজা রেখে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপবিত্র তথা নাপাক থাকলে রোজা মাকরূহ হয়ে যাবে।
৯। দাঁতে ছোলা/বুটের চেয়ে ছোট কোন বস্তু আটকে থাকলে তা বের করে মুখের ভিতর থাকা অবস্থায় গিলে ফেলা।
১০। রোজা রেখে অশ্লীল সিনেমাসহ অশালীন কিছু দেখা বা যৌন উত্তেজক লেখা পড়া বা কাজ করলে রোজা মাকরূহ হয়ে যাবে।
৯. প্রশ্ন: কাদের উপর রোজা ভাঙ্গলে কাজা করা ফরজ?
জবাব: ১. যারা হায়েয ও নিফাসের কারণে রোজা ভেঙ্গেছে, তাদের উপর রোজার কাযা দেয়া (পূরণ করা) ফরজ । এই দুই কারণে রোজা ভাঙ্গাও ফরজ, কাযা দেয়াও ফরজ । মুয়ায রা. বর্ণনা করেছেন, আমি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম: “মাসিকের কারণে বাদ দেয়া রোযা কাযা করা ফরয, কিন্তু একই কারণে বাদ যাওয়া নামায কাযা করার ফরয নয় কেন? “তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন: “তুমি কি খারেজি? (উল্লেখ্য, খারেজিরা সব ব্যাপারে যুক্তি খুঁজে বেড়ায়, এমনকি ইবাদতের ক্ষেত্রেও)। আমি বললাম: না আমি খারেজি নই। তবে আমি বিষয়টি জানার জন্যে প্রশ্ন করেছি।’ তখন উম্মুল মুমিনীন বললেন: “কারণ আর কি? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মাসিকের কারণে ভঙ্গ হওয়া রোযা কাযা করার নির্দেশ দিয়েছেন আর নামায কাযা দেয়ার নির্দেশ দেননি ।” (সহীহ মুসলিম)
২. সফরে যারা রোযা ভাংবেন, তাদের উপরও রোযার কাযা দেয়া ফরয ।
৩. সাময়িক রোগের কারণে যারা রোযা ভাঙবেন তাদের উপরও রোযা কাযা দেয়া ফরয।
৪. হানাফি মযহাবের মতে, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েরা রোযা ভাঙলে তাদেরকে সেই রোযার কাযা দিতে হবে।
১০. প্রশ্ন: কারা রোযা ভাংতে পারবে এবং ভাংলে ফিদিয়া দিলেই চলবে?
জবাব: যাদের জন্যে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে, তবে ফিদিয়া দিতে হবে, তারা হলো:
১. অতিশয় বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা । তাদের জন্যে রোযা না রেখে ফিদিয়া দেবার অনুমতি রয়েছে । তবে ইমাম মালেক ও ইবনে হাযমের মতে তাদের রোযা কাযাও করতে হবেনা, ফিদিয়াও দিতে হবেনা ।
২. সেইসব রোগী যাদের পক্ষে রোযা রাখা অতিশয় কষ্টসাধ্য এবং ভবিষ্যতেও রোগ নিরাময়ের আশা নেই ।
৩. সেই সব শ্রমিক, যারা সারা বছর চরম কষ্টকর শ্রমে নিয়োজিত থাকে এবং এছাড়া যদি তাদের রোজগারের অন্য কোনো সুযোগ না থাকে।
৪. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা, যদি তারা নিজের ও সন্তানের জীবনহানি, কিংবা চরম স্বাস্থ্যহানির আশংকা করে । -এটা ইবনে আব্বাস রা.-এর মত। তিনি সূরা বাকারা ১৮৪ আয়াতের ব্যাখ্যায় এমত দিয়েছেন।
১১. প্রশ্ন: ফিদিয়া কী? ফিদিয়া কিভাবে দিতে হবে?
জবাব: কুরআন এবং হাদিসে বিভিন্ন কারণে কিছু লোককে রোযা রাখা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে রোযা না রাখার কারণে ফিদিয়া দিতে বলা হয়েছে । ফিদিয়া হলো: একজন মিসকিন (অভাবী) ব্যক্তিকে দু’ বেলা আহার করাবেন। আহার করাবেন সামর্থ অনুযায়ী কিংবা মধ্যম ধরনের। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, খাওয়ানোর পরিবর্তে খাবার মূল্য দিয়ে দিলে হবে কিনা? -এর জবাবে আমরা বলবো, না তা হবেনা। খাওয়াই খাওয়াতে হবে। তবে যদি মূল্য দিতে চান, তা দিয়ে খাবার কিনে দেবেন, অথবা খাবার কেনা
নিশ্চিত করবেন, যা এ নির্দিষ্ট মিসকিন (অভাবী ব্যক্তি) আহার করবেন।
১২. প্রশ্ন: রোযার কাফ্ফারা কী? কি কারণে কাফ্ফারা দিতে হয়?
জবাব: এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখ করা হলো:
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্পাল্লাহছু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে নিবেদন করলো: “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন: “কিসে তোমাকে ধ্বংস করেছে?”
সে বললো: “আমি রমযান মাসে রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি।” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্মাম বললেন: “তোমার কি একটি দাস/দাসী মুক্ত করবার সামর্থ আছে?”
লোকটি বললো: “জী-না ।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি কি অবিরাম দুই মাস রোযা রাখতে পারবে?”
সে বললো: “জী-না।”
তিনি জানতে চাইলেন: “তবে কি তুমি ষাটজন মিসকিনকে খাবার খাওয়াতে পারবে?”
লোকটি বললো: “জী-না ।”
বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি রাসূলুল্লাহর দরবারে বসে থাকা অবস্থায়ই কোথাও থেকে তার দরবারে এক ঝুড়ি খেজুর হাদিয়া এলো । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুরসহ ঝুঁড়িটি তার হাতে দিয়ে বললেন:
লোকটি আরয করলো: “এগুলো কি আমার চাইতেও অধিক দরিদ্রকে দান করবো? এ শহরে তো আমার চাইতে অধিক দরিদ্র কোনো পরিবার নেই।” লোকটির কথায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম হেসে উঠলেন, অতপর বললেন: “তবে নিয়ে যাও, এগুলো তোমার পরিজনকে নিয়ে খেতে দাও।”-এ হাদিসটি সিহাহ সিত্তার ছ’টি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। (হাদিসে যে ঝুড়ির কথা উল্লেখ হয়েছে তাতে সম্ভবত পনের সা’ অর্থাৎ ষাট মুদ খেজুর ধরতো এবং প্রতি মিসকিনকে একমুদ করে ষাটজন মিসকিনকে খাওয়ানো যেতো ।)
হাদিস থেকে বুঝা গেলো, রমযান মাসে রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করলে রোযার কাফফারা দিতে হবে । কাফফারা হলো:
১. একজন দাস বা দাসী মুক্ত করা। কিন্ত যদি দাস বা দাসী না থাকে,
২. তবে অবিচ্ছিন্নভাবে দুই (চন্দ্র) মাস রোযা রাখতে হবে । কিন্তু এটা যদি অতিশয় কষ্টসাধ্য হয়, তাহলে-
৩. ষাটজন মিসকিনকে (অভাবীকে) আহার করাবে । অর্থাৎ ষাটটি রোযার প্রতি দিনের জন্যে একজনকে আহার করাবে। ক্রম ধারার ভিত্তিতে ।
কিম্তু ইমাম আহমদের মতে, হাদিসে উল্লেখিত তিনটি বিষয় একটি আরেকটির বিকল্প নয়, বরং তিনটির যে কোনোটি করলেই কাফফারা আদায় হয়ে যাবে।
১৩, প্রশ্ন: হাঁপানী রোগীরা রোজা রেখে ইনহেলার ব্যবহার করতে পারবে কি?
জবাব: হ্যাঁ, রোযা রেখে ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে । চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ইনহেলারে রোযা ভঙ্গ হবার মতো কিছু নেই ।
১৪. প্রশ্ন: রোযা রেখে ইনজেকশন দেয়া যাবে কি এবং ইনসুলিন নেয়া যাবে কিঃ
জবাব: হ্যাঁ, রোযা রেখে গুকোজ সেলাইন ও পুষ্টি জাতীয় ছাড়া অন্যান্য ইনজেকশন দেয়া যাবে । ডায়াবেটিস রোগীরা ইফতারের পূর্বে ইনস্যুলিন নিতে পারবেন। এতে রোযার ক্ষতি হবেনা ।
১৫. প্রশ্ন: রোযা রেখে কাউকেও রক্তদান করা যাবে কি?
জবাব: রোযা রাখা অবস্থায় অধিক পরিমাণ রক্ত বের হলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই রোযা অবস্থায় রক্ত দান করা যাবেনা ।
১৬. প্রশ্ন: মেডিকেল টেস্টের জন্যে ল্যাব–এ রক্ত দিলে রোযা নষ্ট হবে কি?
জবাব: রোযাদারের শরীর থেকে অল্প পরিমাণ রক্ত বের হলে রোযা নষ্ট হয়না । সে হিসেবে মেডিকেল টেস্টের জন্যে ল্যাব-এ রক্ত দিলে রোযা নষ্ট হবেনা ।
১৭. প্রশ্ন: রোযা রেখে চোখে সুরমা লাগালে রোযা ভঙ্গ হবে কি?
জবাব: হানাফি ও শাফেয়ী মযহাব অনুযায়ী রোযাদার চোখে সুরমা লাগালে তার রোযা ভঙ্গ হবেনা ।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম মালেকের মতে কণ্ঠনালীতে সুরমার স্বাদ অনুভূত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১৮. প্রশ্ন: রোযাদাররা, চোখ, নাক ও কানে ওষুধের ড্রপ দিতে পারবে কি?
জবাব: হ্যাঁ রোযা রেখে নাক, কান ও চোখে ওষধের ড্রপ ব্যবহার করতে পারবেন । ওষুধ মুখে বা গলায় চলে এলে না গিলে বাইরে থুথু ফেলবেন।
১৯. প্রশ্ন: রোযা রেখে খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করা যাবে কি?
জবাব: হ্যাঁ, প্রয়োজনের কারণে (রাঁধুনিদের) খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করা এবং বাচ্চাদের শক্ত খাবার চিবিয়ে দেয়া জায়েয । বিনা প্রয়োজনে এমনটি করা মাকরূহ।
২০. প্রশ্ন: রোযা রেখে স্বামী–স্ত্রী পরস্পরকে চুমু খেতে পারবে কিঃ
জবাব: হ্যা, রোযা রেখে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া, আলিঙ্গন করা জায়েয । উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এবং উম্মে সালামা রা. বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা অবস্থায় তার স্ত্রীদের চুমু খেতেন। (বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থ) কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন চুমু খাওয়া মাকরুহ। তবে এর ফলে
বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
২১ প্রশ্নঃ গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় ভোর হলে তার বিধান কি?
জবাব: রোযাদার যদি গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে, তবে তার বিধান কি? এ প্রসঙ্গে দু’টি হাদিস উল্লেখ করা হলো: ১. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রমযান মাসে রসূলুল্লাহ সা. -এর এমন বহুবার হয়েছে যে, গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় তার সকাল হয়েছে এবং তা স্বপ্নদোষের কারণে নয়, বরং স্ত্রী সহবাসের কারণে । অতপর তিনি (সকালে শয্যা ত্যাগ করে) গোসল করতেন এবং রোযা রাখতেন । (সহীহ মুসলিম)
২. উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: অনেক সময় গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় রসূলুল্লাহ সা.-এর সকাল হতো। স্বপ্নদোষের কারণে নয়, স্ত্রী সহবাসের কারণেই তার উপর গোসল ফরয হতো । তা সত্ত্বেও তিনি রোযা ত্যাগ করতেন না এবং সেই রোযার কাযাও দিতেন না। (সহীহ মুসলিম)
ইমাম নববী লিখেছেন, গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় সকাল হলে রোযা সহীহ হবে কিনা এ বিষয়ে আলিমদের মধ্যে যে মতপার্থক্য ছিলো, পরবর্তী কালে তা দূর হয়ে গেছে। এমনকি বলা হয়ে থাকে, এর্প ব্যক্তির রোযা যে সহীহ হবে, সে ব্যাপারে আলিমদের ইজমা (ঐক্য) হয়েছে । মূলত উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা এবং উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রা. বর্ণিত হাদিস সকল মতপার্থক্যের বিপক্ষে প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদা রাখে ।
২২। রমজান মাসের নফল ইবাদত কি কি?
১। কুরআন তেলাওয়াত
২। নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ তথা ক্বিয়ামুল লাইল
৩। দ্বীন সম্পর্কে পড়াশুনা ও জ্ঞানার্জন
৪। দ্বীনি বিষয়ে পরস্পর আলোচনা
৫। যিকির
৬। দান সাদকাহ
৭। মাসনূন দু’আ
৮। রোজাদারকে ইফতার করানো
৯। বেশি বেশি তওবা ও ইসতেগফার
১০। দুরুদ শরীফ পড়া
২৩। রমজান মাসে কি কি করবো?
জবাবঃ
১। সত্য বলবেন, সত্যপন্থী হবেন
২। বেশি বেশি নফল ইবাদাতে মনযোগী হবেন
৩। অপরের সাথে দ্বীনি বিষয়ে আলাপ আলোচনা করবেন
৪। বেশি বেশি দান সদকা করবেন
৫। কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য বেশি বেশি অধ্যয়ন করবেন
৬। কুরআন তেলাওয়াত, দ্বীনি আলোচনা, ইসলামী সঙ্গীত শুনবেন
৭। কুরআন-হাদীসের আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল, ইসলামী সঙ্গীতের ভিডিও দেখবেন
৮। সুন্নতে রাসুলের আমল করবেন
৯। নিজের ভুল স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করবেন
১০। অপরের বিবাদ মিমাংসা করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন
২৪। রমজান মাসে কি কি করা যাবে না?
জবাবঃ
১। মিথ্যা বলবেন না
২। ছোট বড় কোনো ধরণের পাপের কাজ করবেন না
৩। বেহুদা কথা-বার্তা বলে সময় অপচয় করবেন না
৪। কোনোভাবেই অনর্থক অপব্যয় করবেন না
৫। অশ্লীল লেখা, সাহিত্য, বই পুস্তক পড়বেন না
৬। গান-বাজনা করবেন না, শুনবেন না
৭। নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল, অশালীন ভিডিও দেখবেন না
৮। বিদয়াত আমল করবেন না
৯। গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা, চোগলখুরী করবেন না
১০। ঝগড়া, বিবাদ, গালি-গালাজ করবেন না
১-২১ প্রশ্নোত্তরেঃ আব্দুস শহীদ নাসিম (বইঃ রমজান প্রস্তুতি ও মাসায়েল)