বুধবার , ২১ জুন ২০২৩ | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. English News
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কাতার বিশ্বকাপ
  6. কৃষি ও প্রকৃতি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খুলনা
  9. খেলা
  10. চট্টগ্রাম
  11. চাকরি
  12. জাতীয়
  13. জীবনযাপন
  14. জোকস
  15. ঢাকা

গণমাধ্যম গণমুখী নয়: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হুমকিতে

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
জুন ২১, ২০২৩ ৬:৩৩ অপরাহ্ণ
গণমাধ্যম গণমুখী নয়: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হুমকিতে

ষ্টাফ রিপোর্টার :
মীর আব্দুল হালিম, আইনজীবী ও পাবলিক পলিসি এনালিস্ট-
ক্লাসিক যুগের প্রিন্ট মিডিয়া, কালের আবর্তনে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও আধুনিক কালের সোশ্যাল মিডিয়া মিলে আমরা গণমাধ্যমকে বুঝি। মানব সভ্যতার পথ পরিক্রমায় এই গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উন্নয়নে এবং মূল্যবোধের চর্চায় গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। মুক্ত-বুদ্ধি চর্চায় এবং মুক্ত মতামত প্রকাশে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’ ।

মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এক সূত্রে গাঁথা। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের উন্নয়নে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২৩ সালে ১৬৩তম স্থানে রয়েছে যা গত বছর গুলির তুলনায় নিম্নগামী। মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর সরকার ও সংবাদপত্র মালিকদের নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহারের কারণে এই সূচক দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে নেমেছে। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং উন্নয়ন সহযোগীগণ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দ্বারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের, নজরদারি, সামাজিক হয়রানি ও রাজনৈতিক হামলা ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন, দন্ডবিধিসহ অন্যান্য আইন অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চলমান রয়েছে।

আমাদের মহান সংবিধানে ৩৯ অনুচ্ছেদে মানুষের “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা”কে “মৌলিক অধিকার” হিসেবে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যা লঙ্ঘিত হলে আদালতে সুবিচার পাওয়া যাবে। অনুচ্ছেদ ৩৯ এর (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ব্যক্তির চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা কিছু শর্তাধীন করে দিয়েছে, এই শর্তারুপ করাটাই একটা সমস্যা। এই শর্তগুলোর আশ্রয় নিয়েই রাষ্ট্রের প্রশাসন বা নির্বাহী বিভাগ মানুষের বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

রাষ্ট্র বাক-স্বাধীনতাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এই ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন কালে গণপরিষদ বিতর্কে ব্যাপক আলোচনা হয়। স্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ও মোঃ আব্দুল আজিজ চৌধুরী ৩৯ অনুচ্ছেদে আরোপিত শর্ত সমূহ “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে” বর্জন করার প্রস্তাব দেন। তাদের যুক্তি ছিল বাক-স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে, তারা উন্মুখ হয়ে আছে যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তারা পাবে। আজকে যে মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে এদেশের মানুষ লড়াই করেছে, সেই মৌলিক অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃতি দিবে এটাই সকলে আশা করে। কোন লোক বা পত্রিকা যদি রাষ্ট্রের মূলনীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য আনে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এমন আইন রয়েছে। তাছাড়া এই শর্ত সমূহ বা জনশৃংখলার অজুহাত দিয়ে বা সুযোগ নিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানুষের মতামত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা হতে পারে। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে কোন প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই প্রদান করতে হবে।

কিন্তু আব্দুল মমিন তালুকদার, মোহাম্মদ নুরুল হক এবং সংবিধান প্রণয়ন মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন উক্ত প্রস্তাবের বিপক্ষে বলেন বাক-স্বাধীনতার অর্থ মিথ্যা রটনা করার অধিকার নয় কিংবা কুৎসা রটনা করার অধিকারও নয়। সেটা বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা থাকা দরকার এবং এজন্যই আইনের দ্বারা বিধি নিষেদের বিধান করা যুক্তিসঙ্গত এবং সেই আইন যুক্তিসঙ্গত হয়েছে কিনা তা বিচার করবে মাননীয় আদালত। বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই জানা দরকার যে, সে স্বাধীনতা আমরা দিয়েছি: কিন্তু তার মানে উশৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া নয় । বাক-স্বাধীনতার মানে লাইসেন্স নয়, আদালতের অপমান করার অধিকার নয়। নৈতিকতার বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের নামে, স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই করা হবে, এইটা কোনদিন রাষ্ট্র সহ্য করতে পারে না, আইনে সমর্থন করতে পারেনা। অবশেষে, কণ্ঠ ভোটের মাধ্যমে শ্রী সেনগুপ্ত ও শ্রী লারমার আনিত সংশোধনী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।

রাষ্ট্র বনাম স্বদেশ রায়, দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬৮ ডিএলআর, এডি ১৬২তে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ ধরনের যৌক্তিক বাধা নিষেধ থাকার বাধ্যবাধকতা তুলে ধরেন। একইভাবে তাইয়েব বনাম বাংলাদেশ ৬৭ ডিএলআর এডি ৫৭ তে আদালত বলেন একজন তার মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে কিন্তু একই সাথে তাকে অন্যান্য আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে কিংবা তার মতামত যাতে অন্য কারো অনুভূতিতে আঘাত না করে সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। কেয়া কসমেটিক লিমিটেড বনাম দেওয়ান হানিফ মাহমুদ ও অন্যান্য ৬৭ ডিএলআর মামলায় আদালত সম্পর্কে মন্তব্য করার কারণে বিবাদীদেরকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।‌ এগুলির মাধ্যমে ধারণা করা যায় রাষ্ট্র কীভাবে নীরবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনোই চূড়ান্ত হতে পারেনা, আবার ব্যক্তিস্বাধীনতা জোর করে অতি নিয়ন্ত্রণ করাও কাম্য নয়, এক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকগণ ব্যাক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দর্পনের ভুমিকা পালন করতে পারে । কেননা সংবাদপত্রে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের স্বাধীনতা একটা সমৃদ্ধ জাতিগঠনে অপরিহার্য, যেটা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পরিলক্ষিত হয়েছিলো, তিনি সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তার শাসনামলে।

তাছাড়া সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” এই ১১ অনুচ্ছেদে একটি মজার ব্যাপার রয়েছে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান সংশোধন করে “এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” এই অংশটি রহিত করা হয় । পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই অংশটি পুনঃ স্থাপনের মাধ্যমে মূল সংবিধানের ভাষ্যটি গৃহীত হয়। আহসানুল্লাহ বনাম বাংলাদেশ ৪৪ ডিএলআর ১৭৯ এবং আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ ৬৪ ডিএলআর ১৬৯এ মামলা সমূহে সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার দিকনির্দেশনার বিষয়ের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে মত প্রকাশে স্বাধীনতার অধিকারকে খর্বকারী আইনসমূহ বাতিল বা স্থগিত বা নৈতিক ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সংশোধন করা এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র টিকবে না। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার দুরন্ত সাহস, সামাজিক সমতা নিরূপণ, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠন ও ন্যায় ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বাক স্বাধীনতা পূর্ব শর্ত। যেদিন গণমাধ্যম নির্ভয়ে সরকারের অনায্য কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে পারবে, যেদিন গণমাধ্যম জনস্বার্থে সত্য মত প্রকাশ করতে পারবে, যে দিন এই সূচক উর্ধ্বমুখী হবে, সেদিনই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি হবে। তখনই আগামীর বাংলাদেশ হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায় ক্ষমতার মালিকানা জনগণের হাতে। এই মালিকানার অধিকারকে জনসাধারণ ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে প্রতিষ্ঠিত করবে। সেজন্যই আমাদের সংবিধান সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া গণতন্ত্র অনুশীলন সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সাংবাদিকতার যে অনন্য ঐতিহাসিক উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে সেই সাংবাদিকতাই গণমানুষের আস্থা অর্জনে নিষ্প্রভ। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সাংবাদিকদের ত্যাগের ইতিহাস কী আজকের যুগের সাংবাদিকদেরকে ওই একই মাতৃভূমিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা যোগাবে না? গণমাধ্যম আরো বেশি গণমুখী হোক, মানবাধিকারের প্রশ্নে আরো বেশি সোচ্চার হোক, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গণমানুষের কাতারে সামিল হোক, সাংবাদিক হোক গণমানুষের, তারা সরকার কিংবা মালিকের আজ্ঞাবহ না হোক, এটাই গণমানুষের প্রত্যাশা।

সর্বশেষ - রংপুর