আগামী বছর বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশের শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে টানা দরপতনের মধ্যে পতিত হয়েছে শেয়ারবাজার। প্রতিদিন লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা বেড়েই চলেছে। বাজারে তালিকাভুক্ত অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম ফ্লো প্রাইসে (দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা) চলে এসেছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী বছর বিশ্বমন্দার আশঙ্কার প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে। রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে।
তারা বলছেন, শেয়ারবাজার অর্থনীতির বাইরে নয়। অর্থনীতির একটি অংশ শেয়ারবাজার। অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। মন্দার কারণে সামনে পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। আবার এখন যে হারে লোডশেডিং হচ্ছে, তাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মূলত, আসন্ন বিশ্বমন্দার প্রভাবেই এখন শেয়ারবাজারে দরপতন চলছে।
তবে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বমন্দার পাশাপাশি সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি নির্দেশনা জারি করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের জমা করা চেক নগদায়ন না হওয়া পর্যন্ত শেয়ার কেনা যাবে না, এটিও শেয়ারবাজারে দরপতনে ভূমিকা রাখছে। আদেশটি পুরোনো হলেও নতুন করে জারি করায় এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিভিন্ন বক্তব্যে আগামী দিনগুলোতে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা বলছেন। সর্বশেষ গতকাল সোমবার (১৭ অক্টোবর) ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২’ পালন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করছি কোনো খাদ্যের অপচয় নয়, যার যেখানে যতটুকু জমি আছে তা চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ান। সারা বিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি সবার প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।’
গত ১১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘…যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সফরের সময় আমি অনেক বিশ্বনেতা ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যেকেই এ বিষয়টি (খাদ্য নিরাপত্তা) নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারা মনে করেন, ২০২৩ সাল খুব ভয়াবহ বছর হবে। খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ হতে পারে।’
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও আগামী বছর বিশ্বমন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘বিশ্বমন্দা কি আসন্ন’- এমন শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের পর এবার অর্থনীতির গতি সবচেয়ে কমে গেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের প্রবৃদ্ধি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এর প্রভাব আগামী বছর মন্দায় রূপ নিতে পারে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে, যা বিগত ৪০ বছরেও দেখা যায়নি। করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করার পর বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এ প্রভাব সামলাতে চাহিদায় লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এই সুদহার বাড়ানোর প্রবণতা কমিয়ে দিচ্ছে অর্থনীতির গতি।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল।
বিভিন্ন পক্ষ থেকে যখন বিশ্বমন্দা ও দুর্ভিক্ষের এমন আশঙ্কার কথা আসছে, তখন দেশের শেয়ারবাজারেও টানা দরপতন চলছে। চলতি সপ্তাহে এখনো পর্যন্ত লেনদেন হওয়া তিন কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। এতে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স তিন কার্যদিবসে ৯৪ পয়েন্ট কমে গেছে। অবশ্য এ দরপতন শুধু চলতি সপ্তাহেই হয়নি, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দরপতনের ধারায় চলছে শেয়ারবাজার। পতনের মধ্যে পড়ে গত এক মাসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ২০০ পয়েন্ট পড়ে গেছে। আর দুই হাজার কোটি টাকার ঘরে উঠে যাওয়া লেনদেন কমে হাজার কোটি টাকায় নেমেছে।
এ দরপতনের বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অবশ্য বিশ্বমন্দার একটা প্রভাব আমাদের শেয়ারবাজারে পড়েছে। বিশ্বমন্দা এরই মধ্যে এসে গেছে। মূল্যস্ফীতি বিশ্বজুড়ে অনেক বেড়ে গেছে। এতে আমাদের রপ্তানি পারফরম্যান্স কমেছে। দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবৃদ্ধির হার কমার আভাস দিচ্ছে। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি এখনো বাংলাদেশের পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো। কাজেই খুব বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে, বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধরে রাখা উচিত। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বাজার ভালো হবে। আর বিক্রি কম হলে দরপতনও কম হবে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, অর্থনীতির মন্দা দেখা দিলে শেয়ারবাজারে এর প্রভাব পড়বেই। শেয়ারবাজার আলাদা কিছু না। অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা থাকে। অর্থনীতি থেকেই তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের আয় আহরণ করে। অর্থনীতির গ্রোথ যদি ঋণাত্মক হয়, তাহলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয়ও কমে যায়। এটিই নিয়ম।
তিনি বলেন, সব দেশেই শেয়ারবাজারে কারেকশন (মূল্য সংশোধন) হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে ৪০-৫০ শতাংশ পড়ে গেছে। আমাদের শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে এর পেছনে মূল কারণ আসন্ন বিশ্বমন্দা। এরই মধ্যে ১৮০টি কোম্পানির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসে চলে এসেছে। এগুলোর খুব একটা লেনদেন হচ্ছে না। বাকিগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিয়ে খেলাধুলা করছে, এগুলোর দাম এখন ধরে রাখতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, মন্দা এবং শঙ্কা সবকিছু মিলেই শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। মূল কথা হলো- মানুষ সামনের কথা চিন্তা করে। প্রবৃদ্ধি কমবে এটা শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট থেকে না, আমরা নিজেরাও টের পাচ্ছি। যদি লোডশেডিং চলতে থাকে, দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা করে কারখানা বন্ধ থাকে, তাহলে তো উৎপাদন কমে যাবে। রপ্তানি সক্ষমতাও কমবে। এটা হয়তো মানুষ চিন্তা করছে। এছাড়া এখানে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করার মতো মানুষ আমি দেখতে পাচ্ছি না।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, সব মহল থেকেই বিশ্বমন্দার কথা আসছে। সরকারের ওপর থেকেও একই কথা আসছে। অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে দরপতনের জন্য এটি একটি বড় কারণ। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জমা করা চেক নগদায়ন না হওয়া পর্যন্ত শেয়ার কেনা যাবে না মর্মে বিএসইসি যে নির্দেশনা দিয়েছে, শেয়ারবাজারে এরও প্রভাব পড়েছে। এসব মিলেই শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কী করণীয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডিবিএর পক্ষ থেকে আমরা আগেও বলেছি এবং এখন আবারও বলছি, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঋণ করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত না। আবার পুঁজির সম্পূর্ণ অংশও বিনিয়োগ করা উচিত না। পুঁজির ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ২৫ শতাংশ হাতে রাখা উচিত। যেন দাম কমার সময় কিনে সমন্বয় করা যায়। একই সঙ্গে আমাদের পরামর্শ থাকবে যেসব কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দেয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যেন সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন।