বুধবার , ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. English News
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কাতার বিশ্বকাপ
  6. কৃষি ও প্রকৃতি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খুলনা
  9. খেলা
  10. চট্টগ্রাম
  11. চাকরি
  12. জাতীয়
  13. জীবনযাপন
  14. জোকস
  15. ঢাকা

পবিত্র শবে বরাতঃ ফজিলত এবং করণীয়-বর্জনীয় আমল

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩ ১২:১০ পূর্বাহ্ণ
পবিত্র শবে বরাতঃ ফজিলত এবং করণীয়-বর্জনীয় আমল

শবে বরাত কোনটি?
হাদিসের পরিভাষায় ‘নিছফে শাবান’ তথা শাবানের মধ্যবর্তী রাতকে বলা হয় শবে বরাত। আর ‘শাবানের মধ্যবর্তী রাত’ বলতে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বুঝানো হয়। শবে বরাত কথাটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ‘শব’ মানে ‘রাত’, আর ‘বরাত’ মানে ‘ভাগ্য’ বা ‘মুক্তি’। সেই হিসেবে ‘শবে বরাত’ অর্থ ‘মুক্তির রাত’ বা ‘ভাগ্য রজনী’। ‘শবে বরাত’ -এর আরবি ‘লাইলাতুল বারাকাত’। তবে হাদিস শরিফে এই ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। হাদিসে বলা হয়েছে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য রজনী। আমাদের এতদাঞ্চল বিশেষতঃ ভারতীয় উপমহাদেশ, পার্শ্ববর্তী ইরানসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এই দিনটি শবে বরাত নামেই সমধিক পরিচিত।

ইসলামি শরিয়ত বছরের যে পাঁচটি রাতকে মর্যাদাপূর্ণ এবং বিশেষ সাওয়াবের রাত হিসেবে নির্ধারণ করেছে শবে বরাত তার ভেতরে ‘লাইলাতুম মিন নিছফে শাবান’ বা ‘শবে বরাত’ অন্যতম। আর বিশেষ ৫ টি রাত হচ্ছে: ১। ঈদুল ফিতরের রাত ২। ঈদুল আজহার রাত ৩। শবে মিরাজ বা মিরাজের রাত ৪। শবে বরাত বা বরাতের রাত এবং ৫। শবে কদর বা কদরের রাত।

এই রাতের কথা কি কুরআনে আলোচিত হয়েছে?
হযরত ইকরামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুসহ কিছু সংখ্যক সাহাবির মতে সূরাহ আদ দুখান -এর প্রথমাংশে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।

একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিখ্যাত অনেক মুফাসসিরিনে কেরাম। তাদের বক্তব্য, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন,
حم

وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ

رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ

لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ

بَلْ هُمْ فِي شَكٍّ يَلْعَبُونَ

فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاء بِدُخَانٍ مُّبِينٍ

‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে। (সুরাহ- আদদুখান, আয়াত: ১-১০)

হাদিসে বর্ণিত শবে বরাতের ফজিলত
এই রাতের ফজিলত বর্ণনায় অনেক হাদিস প্রচলিত রয়েছে। এর সবগুলো সহিহ বা বিশুদ্ধ নয়। আমরা শুধু বিশুদ্ধ হাদিসগুলো থেকে আমল করার চেষ্টা করবো। আল্লাহ পাক আমাদের আমলের তাওফিক দান করুন।

হজরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা শাবানের মধ্যবর্তী রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ্ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)। হজরত আওফ ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে ইবনে খুজাইমা হজরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে এবং আবু মুসা আশআরী রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে এ রকম বর্ণনা করেছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, রাজীন: ২০৪৮; সহিহ্ ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আল্লাহ তাআলা এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকি সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৭৬)।

হজরত উসমান ইবনুল আস রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে বর্ণিত, ‘এ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক ও ব্যভিচারিণী ছাড়া সবার ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন।’ (বাইহাকি, শুআবুল ইমান, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩৮৩)।

হজরত আবু সালাবা রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে বর্ণিত, ‘যখন শাবানের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না।’ (কিতাবুস সুন্নাহ, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।

হজরত আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআলা অানহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দুআ ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।

আরেক হাদিসে বর্নিত। হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআলা অানহা বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদাহ করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদাহ থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার দীর্ঘ সিজদাহ থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (বাইহাকি, শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)।

শবে বরাতে পালনীয় নফল নামাজ ও ইবাদত
ইবনে মাজাহ বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে।’ (ইবনে মাজাহ)

হজরত আলী রাদিআল্লাহু তাআলা অানহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক দেব; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করবো। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং: ১৩৮৪)।

মধ্য শাবানের নফল রোজা
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করো ও দিনে রোজা পালন করো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

এছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজ -এর নফল রোজা তো রয়েছেই। যা আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিসসালাম পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ রোজাগুলো পালন করতেন; যা মূলত সুন্নত। সুতরাং তিনটি রোজা রাখলেও শবে বরাতের রোজা এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ দিনের রোজা আইয়ামে বিজ, অর্থাৎ চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৫১)।

এতদ্ব্যতিত মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ; শবে কদরের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি বা হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম -এর পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও সর্বোপরি প্রতিটি বিজোড় তারিখে রোজা পালন করা হয়ে যায়; এবং শবে কদরের রোজাও স্বাভাবিকভাবেই এর ভেতরে শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাস ছাড়া রজব ও শাবান মাসে সবচে’ বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন; শাবান মাসে কখনো ১০ টি, কখনো ১৫ টি, কখনো ২০ টি নফল রোজা রাখতেন। কখনওবা আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ এমনও বর্ণনা করেছেন যে, ‘রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে বেশি পরিমানে এবং ধারাবাহিকভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন মনে হতো তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না।’ (মুসলিম)।

শবে বরাতের অপরিহার্য্য অনুসঙ্গ হালুয়া রুটির মাহাত্ম্য
হালুয়া রুটির সাথে শবে বরাতের অলিখিত একটি সম্পর্ক কায়েম হয়েছে আমাদের সমাজে। অনেকের নিকট এই দিবসে হালুয়া রুটির গুরুত্ব নফল ইবাদাত এবং অন্যান্য নেক আমলের চেয়েও বেশি। দিনভর রুটি বানিয়ে, গোস্ত ইত্যাদির আয়োজনে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত শরিরে রাতের ইবাদাত আর করা সম্ভব হয় না অনেকের। এমনটা নিতান্ত দু:খজনক। হালুয়া রুটির সাথে শবে বরাতের বিশেষ সম্পর্ক কায়েম করা নিরর্থক। হালুয়া রুটি গোস্ত ইত্যাদি উপাদেয় খাবার আয়োজনের ব্যবস্থা থাকলে আপনি এগুলো তৈরি করতে পারেন। নিজেরা খান এবং অন্যদের খাওয়ান। অভাবী গরিব দু:খীদের পানাহার করান। এগুলো সাওয়াবের কারণ হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই যে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন, এগুলোকে এই দিবসের সাথে আবশ্যিক করে নেয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। বরং শবে বরাত হলো ইবাদতের রাত। দান-খয়রাত করা ও মানুষকে খাওয়ানো এগুলোও উত্তম ইবাদত। তবে এই দিন ও রাতকে হালুয়া-রুটির আমলের দিবসে পরিণত করে ইবাদত থেকে গাফেল হওয়া যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনি হালুয়া রুটি নিষিদ্ধের জন্য ফতোয়া প্রদান করে প্রকারান্তরে এই পূণ্যময় রাতটিকেই বিতর্কিত করা কিংবা ‘শবে বরাতের কোনো আমল নেই’ ইত্যাকার বানোয়াট কথা ছড়িয়ে দিয়ে এই বরকতপূর্ণ রাতের সাওয়াবলাভ থেকে বঞ্চিত রাখার প্রচেষ্টাও কোনো ক্রমেই প্রজ্ঞাপ্রসূত নয়।

শবে বরাতে করণীয় আমল
শবে বরাতে যেসব আমল করা উচিত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
এক. নফল নামাজ। নফল নামাজের ভেতরে তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, ছলাতুল হাজাত, ছলাতুশ শোকরসহ অন্যান্য নফল নামাজ পড়া যেতে পারে।
দুই. নামাজে কিরাআত ও রুকু সিজদাহ দীর্ঘ করা।
তিন. পরের দিন নফল রোজা রাখা।
চার. বেশি পরিমানে কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করা।
পাঁচ. সাইয়্যিদুল মুরছালীন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর বেশি বেশি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করা।
ছয়. অধিক পরিমানে তাওবা-ইস্তিগফার করা। আল্লাহ পাকের নিকট রোনাজারি করা।
সাত. তাসবিহ তাহলিল, জিকির আজকার এবং দুআর আমল অধিক পরিমানে করা।
আট. কবরবাসী মাতা পিতা এবং মৃত আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা। কোনো কারণে সম্ভব না হলে দূরে থেকে কবর জিয়ারতের নিয়্যাতে তাদের রূহের উদ্দেশ্যে ঈসালে সাওয়াব তথা সাওয়াব রেছানী করা।
নয়. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দুআ করা। বিশ্ববাসী সকল মানুষের শান্তি-সমৃদ্ধি, কল্যান কামনা করে তাদের হেদায়েতের জন্য, সুপথপ্রাপ্তির জন্য বিনীত অন্তরে আল্লাহ পাকের নিকট কায়োমনোবাক্যে প্রার্থনা করা।

শবে বরাতে বর্জনীয় আমল
পবিত্র শবে বরাতের প্রচলিত আমলে আমাদের সমাজে কিছু অনর্থক কাজ যুক্ত হয়েছে, যেগুলো করা উচিত নয়। যেগুলো থেকে প্রত্যেকের বিরত থাকা একান্তই উচিত। যেমন:
এক. আতশবাজি, পটকা ফোটানো।
দুই. অপ্রয়োজনে রাতের অধিক সময় ধরে মাইক বাজিয়ে অন্য কারও ইবাদত কিংবা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো।
তিন. ইবাদত আমল বাদ দিয়ে অনর্থক ঘোরাফেরা করে এই রাতের মূল্যবান সময় অতিবাহিত করা।
চার. অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ উল্লাসে লিপ্ত হওয়া।
পাঁচ. অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা।
ছয়. হালুয়া রুটি বা খাওয়া দাওয়ার পেছনে অনেক বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।

সকল প্রকার কট্টরপন্থা ক্ষতিকর: ইবাদাতে কঠোরতা কাম্য নয়
একদল মানুষ বেরিয়েছেন হাল আমলে। দু:খজনকভাবে তারা নিজেদের মতো করে ইসলামি শরিয়তের বিধি বিধানকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। দ্বীনের অধিকাংশ বিষয়ে তারা কট্টরপন্থা অবলম্বন করতে চান। তারা নিজেদের বিশ্বাস ও আমল ছাড়া বাদবাকিদের বিদআতী বলে প্রশান্তিলাভ করেন। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ইসলামের অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত আমলকেই তারা ‘বেহুদা’, ‘অনর্থক’ কিংবা ‘বিদআত’ বলে উড়িয়ে দিতে চান। তারা বলে থাকেন, নামাজের পরে দুআ মুনাজাত বিদআত। তাদের মতে- নফল আমল, জিকির আজকার ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয়। দরূদ ও সালাম পাঠ বিদআত। জুমুআহর নামাজের আগে পরে আমরা যে হাদিস এবং সুন্নাহর আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত ৪ রাকাআত ক্কাবলাল জুমুআহ এবং ৪ রাকাআত বা’দাল জুমুআহ পড়ি- তাদের নিকট এগুলোর ভিত্তি নেই। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, পবিত্র হজ কিংবা উমরার উদ্দেশ্যে মক্কাতুল মুকাররমাহ গেলেই হয়ে যায়। এসব সফরে মাদিনাতুল মুনাওয়ারাহ জিয়ারতে যাওয়ার কি দরকার? সাইয়্যিদুল মুরছালীন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা যিয়ারতে মাদিনাতুল মুনাওওয়ারাহ যাওয়ার প্রতিও তাদের অনিহা। তারা যেতে নারাজ। অন্যদেরও যাতায়াত তাদের মর্মপীড়ার কারণ। এই মহান আমলটি থেকেও তাদের নিকট না কি বিদআত বিদআত গন্ধ আসে। তাদের যুক্তি বুঝতে কষ্ট হয় না। একটু চিন্তা করলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়, এই শ্রেনির নব্য আমলওয়ালা অতি সহিহ, অতি বিশুদ্ধ, অতি উতসাহীগনের দূরভিসন্ধি যে, মুসলিমদের আমল থেকে দূরে রাখা তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। এরা হাদিসের দোহাই দিলেও প্রকৃতপক্ষে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে- অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাদিস নিজেরাই মানেন না।

আফসোস! তাদের জন্য। তবে আমাদের পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ তাদের জন্য নয়, বরং তাদের জন্য সঠিক পথপ্রাপ্তির দুআ সবসময়। দ্বীনের প্রায় প্রতিটি আমলের ক্ষেত্রেই তারা সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্তিতে ফেলেছেন। এই পবিত্র শবে বরাতের ব্যাপারেও তাদের অপবাদের অন্ত নেই। ‘শবে বরাত বলতে কিছু নেই’, ‘হাদিসে এর উল্লেখ নেই’, ‘শবে বরাত বিদআত’ ইত্যাদি নানান অপপ্রচারে মানুষদের এই পূন্যময় রজনীর বরকত হাসিল থেকে নিবৃত্ত করতে তারা সদা সচেষ্ট। তবে সচেতন মুসলমানগন মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না ইনশাআল্লাহ। তারা এই রাতে ইবাদাত করে এবং পরের দিন রোজা রেখে, বিদ্বেষমুক্ত অন্তর আর শিরকমুক্ত আমলের মাধ্যমে এদের অপপ্রচারের জবাব দিয়ে দিবেন। আল্লাহ পাক আমাদের সকল প্রকার কট্টরপন্থা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে কুরআন সুন্নাহ অনুসারে সঠিক পন্থায় সকল আমল করার তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ - রংপুর